পুলিশ কেন দুর্নীতি করে
গত ৩১ আগস্ট ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’ শীর্ষক জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে। এ ফলাফল নিয়ে বড় পত্রিকাগুলো তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনামও করেছে।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে টিআইবি যেসব কাজ করে থাকে, এটি তার অন্যতম। জরিপের ফলাফলে টিআইবি জানিয়েছে, দেশের ৭০.৯ শতাংশ নাগরিক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।
এ জরিপের ফলাফলে দেশের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিযুক্ত খাত হিসাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পরে রয়েছে পাসপোর্ট অফিস ও বিআরটিএ। এরপর রয়েছে স্থানীয় সরকার ও ভূমিসেবা এবং বিচার বিভাগীয় সেবা। যারা বিভিন্ন অফিসে কাজকর্ম করতে যান, তারা এসব জানেন।
সে কারণে নাগরিক সমাজের কাছে টিআইবির এ রিপোর্টের গুরুত্ব না থাকলেও দুর্নীতি গবেষকদের কাছে, বিশেষ করে যারা দেশে ও বিদেশে দুর্নীতি নিয়ে লেখালেখি ও গবেষণা করেন, তাদের কাছে এর কিছুটা গুরুত্ব থাকতে পারে। ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি রোধে টিআইবি যেসব সুপারিশ করেছে, সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সরকার যদি এ গবেষণার ফলাফলকে সতর্কঘণ্টা হিসাবে বিবেচনা করে এ লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে এমন গবেষণার মূল্য আছে।
তবে প্রশ্ন হলো, সরকার কি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর উদ্যোগ নেবে? রাজনৈতিক কারণে সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে হয়। সেজন্য সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে গত নির্বাচনের পর ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এ ঘোষণা ‘কাগুজে’ ঘোষণা হয়েই টিকে আছে। বাস্তবে দুর্নীতিবাজরা বহাল তবিয়তে দুর্নীতি করে যাচ্ছে। বড় বড় দুর্নীতিবাজ এ সরকারের আমলে অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্রয় পাচ্ছে।
যেমন, মানি লন্ডারিং করে যারা বিদেশে টাকা নিয়ে গেছেন, সে টাকা ফিরিয়ে আনলে তাদের আর আইনের মুখোমুখি হতে হবে না। আবার প্রতিবার আয়কর রিটার্নে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়াকে বড় দুর্নীতিবাজদের পরোক্ষ প্রশ্রয় দেওয়া বলা যায়। এসব অনুধাবন করে সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণকে শো অফ হিসাবে অভিহিত করা যায়। এ পরিস্থিতিতে সমাজ ও রাজনীতিতে একটি দুর্নীতিবান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠেছে। এ থেকে বের হতে হলে স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে যে সরকার গঠিত হবে, তাকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দলমতনির্বিশেষে দুর্নীতিবাজদের প্রতি রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
টিআইবির সেবা খাতের দুর্নীতির খানা জরিপ প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত বলা হয়েছে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা যুক্তিসংগত হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলতে প্রধানত বোঝানো হয় পুলিশবাহিনীকে। অবশ্য এর সঙ্গে আরও অনেক সহযোগী বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা পালন করে থাকে। যেমন: র্যাব, বিজিবি এবং পুলিশের বিভিন্ন বাহিনী। পশ্চিমা সমাজে স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে বড় হয়ে পুলিশ অফিসার এবং ফায়ার ফাইটার হতে চায়। তাদের মনে পুলিশ সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে।
কারণ, তারা গণমাধ্যমে অপরাধ দমনে পুলিশের ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যক্ষ করে নিজেদেরও তেমন হিরো ভাবতে উদ্বুদ্ধ হয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয়, বিশেষ করে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যেই বলুন আর নাগরিক সমাজের মধ্যেই বলুন, পুলিশ সম্পর্কে যে ধারণা রয়েছে তা অত্যন্ত নেতিবাচক। তাদের অনেকেই মনে করেন, পুলিশ মানেই ঘুসখোর। পুলিশ মানেই নির্যাতনকারী ও অত্যাচারী। এ কারণে তারা বাধ্য না হলে কোনো সাহায্যের জন্য পুলিশের সহায়তা নিতে চান না।
গণমানসে পুলিশের এই মন্দ ইমেজ রাতারাতি তৈরি হয়নি। আর এজন্য কেবল পুলিশ বাহিনীই দায়ী নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে হয়।
এজন্য ক্ষমতাসীন সরকার পুলিশকে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। ফলে পুলিশ অপরাধ দমনের চেয়ে রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনে বেশি সক্রিয় হয়ে কাজ করে থাকে। ক্ষমতাসীন সরকারকে প্রায়ই পুলিশকে বিরোধীদলীয় আন্দোলন দমনে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এছাড়া নির্বাচনের সময় পুলিশ সরকারি দলের পক্ষে কাজ করে। রাতের বেলায় ভোট কেটে বাক্স ভরলেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকে। সরকারদলীয় কর্মী ও ক্যাডারদের দুর্নীতি পুলিশ না দেখার ভান করে এবং বিরোধীদলীয় কর্মী-ক্যাডারদের প্রতি কঠোর আচরণ প্রদর্শন করে।
পুলিশের ইতিবাচক ইমেজ গড়ে না ওঠার পেছনে দুটি সক্রিয় কারণ রয়েছে। এর প্রথমটি হলো আইন। আর দ্বিতীয়টি হলো পুলিশের কর্মকাণ্ডের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের পুলিশ পরিচালিত হয় ব্রিটিশ আমলের ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন দিয়ে। আড়াই শতাধিক বছর ধরে এ মান্ধাতার আমলের আইন দিয়ে পুলিশ চলছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ৫০ বছর পার করেও কোনো সরকারই পুলিশের জন্য একটি গণবান্ধব আইন তৈরি করতে পারেনি।
এজন্য স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশ পরিচালনায় থাকা তিনটি বড় দলকেই দায়ী করা যায়। তবে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকার অসাংবিধানিক হলেও একটি ভালো কাজ করেছিল। ওই সরকার পুলিশ আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল। সেসময় পুলিশ আইন যুগোপযোগী করার জন্য অবসরপ্রাপ্ত আইজি এসএম শাজাহানের নেতৃত্বে কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই কমিটি এতদঞ্চলের দেশগুলোর পুলিশ আইন পর্যালোচনা করে একটি জনবান্ধব পুলিশ সংস্কার অধ্যাদেশ তৈরি করেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ওই দুই বছরের সরকার অধ্যাদেশটি পাশ করে যায়নি।
রাজনৈতিক নেতারা ওই সময় আশ্বাস দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এসে তারা এ অধ্যাদেশটি পাশ করবেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার সে ওয়াদা রাখেনি। অধ্যাদেশটি পাশ করা হলে পুলিশ হয়তো একটি জনবান্ধব বাহিনী হতে পারত। অধ্যাদেশটিতে অনেক ভালো উদ্যোগের মধ্যে পুলিশ কমপ্লেইন্ট কমিশন সৃষ্টির সুপারিশ ছিল। পুলিশি আচরণে সংক্ষুব্ধ হলে কোনো ব্যক্তি ওই কমিশনে অভিযোগ করতে পারতেন। কিন্তু কেন অধ্যাদেশটি পাশ করা হয়নি, এ প্রশ্নের জবাব সরকারই দিতে পারবে।
পুলিশের জনপ্রিয় হওয়ার পথের দ্বিতীয় বাধাটি হলো পুলিশের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে পুলিশ নাগরিক সমাজকে অনেক বেশি সেবা দিতে পারত। কিন্তু যে দলই ক্ষমতায় থাকে, তারাই পুলিশকে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে। ফলে পুলিশকে রাজনৈতিক নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে হয়। অনেক সময় তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের নাজেহাল করে সরকারি দলকে খুশি করতে হয়। পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সরকারের হাতে থাকায় পুলিশ অনেকটা বাধ্য হয়ে সরকারি নির্দেশ পালন করে। এজন্য স্বাভাবিক সময়ে বা নির্বাচনের সময়ে পুলিশ সরকার অঘোষিত নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে। সেজন্য ফাঁড়ি ও থানা থেকে শুরু করে পুলিশ পদসোপানের পদে পদে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের পরিবর্তে পুলিশ এখন নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত। এ কারণে সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। এজন্যই টিআইবির দুর্নীতির খানা জরিপে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবচেয়ে বেশি দুর্নীতগ্রস্ত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
এ কথা সত্য, পুলিশ বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। তবে এ সত্যও অনস্বীকার্য যে, এর মধ্যেও বিরল ব্যতিক্রম হলেও এ বাহিনীর কিছু সদস্য সৎভাবে জীবনযাপনের জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। তাদের সংখ্যা অনেক কম। তারা খুবই দুরবস্থার মধ্যে আছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমন পুলিশ সদস্যদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি করে দেওয়া হয়। তবে নাগরিক সমাজেরও দোষ আছে। তারা সমাজে এমন একটি পুলিশবিরোধী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, যেখানে পুলিশের ভালো কাজ প্রশংসিত হয় না; শুধু নিন্দিত হয় পুলিশের অপকর্ম। পুলিশ ঘুস-দুর্নীতিতে জড়িত হলে তার নিন্দা করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পুলিশ কোনো ভালো কাজ করলে নাগরিক সমাজ তার প্রশংসা করে না কেন? নাগরিকদের এ অভ্যাস পরিবর্তন করা জরুরি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য যখন মাজারের টাকা আত্মসাৎ করে বা কাউকে বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে হত্যা করে অথবা নারায়ণগঞ্জে সেভেন মার্ডারে জড়িত থাকে, তখন নাগরিক সমাজ এসব ঘটনার ব্যাপক নিন্দা করেছে। এ সমালোচনা ও নিন্দা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের প্রাপ্য। কিন্তু পুলিশ যখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অপরাধীকে গ্রেফতার করে, তখন কি এর প্রশংসা করা হয়? পুলিশ যখন মাথায় গুলি খেয়ে জঙ্গি নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইকে গ্রেফতার করেছিল, তখন কিন্তু নাগরিক সমাজ পুলিশের প্রতি ধন্যবাদ জানায়নি। নাগরিক সমাজ পুলিশের মন্দ কাজের নিন্দা করতে জানলেও তাদের ভালো কাজের প্রশংসা করতে অভ্যস্ত নয়। এই একচোখা কালচার থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, পুলিশও মানুষ। চাকরি ক্ষেত্রে তাদের কতটা সুযোগ-সুবিধা ও স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়টি স্মরণে রাখা দরকার। তাদের ঝুঁকি ভাতা ও বেতনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কতটা বাড়ানো হয়েছে সে বিষয়টিও মাথায় রাখা প্রয়োজন। পুলিশ আইন যুগোপযোগী করাসহ এসব পদক্ষেপ গ্রহণের পরও যদি পুলিশ অন্যায় করে, মানুষকে নির্যাতন করে, তাহলে ওইসব পুলিশ অফিসারকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে পুলিশের দুর্নীতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।