পরিবহন ব্যবসায়ীকে ‘গুম’ করেছে ডিবি!
ফেরত দেয়ার কথা বলে এক বছরে স্ত্রীর কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগ * ‘তারা প্লাস দিয়ে শামীমের হাত ও পায়ের নখ তুলে ফেলে’
ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি টিমের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম থেকে তুলে নেয়ার পর পরিবহন ব্যবসায়ী শামীম সরদারকে গুম করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে তুলে নেয়া আরও ছয়জনকে ঢাকার দুটি থানায় পৃথক মাদক মামলায় চালান দেয়া হলেও শামীমের কোনো খোঁজ মিলছে না।
তার (শামীমের) স্ত্রী চম্পা বেগমের অভিযোগ, ঢাকা ডিবির ওই টিমের সদস্য মোতাহের হোসেন তার স্বামীকে ফেরত দেয়ার কথা বলে কয়েক দফায় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এক বছর ধরে বলেছেন, তার স্বামী (শামীম) জীবিত আছেন, চিকিৎসাধীন আছেন, কখনও বা বলেছেন সিলেট জেলে, কখনও বা গাজীপুর জেলে আছেন। শেষ পর্যন্ত ডিবির সংশ্লিষ্ট ওই টিম বলছে; তারা শামীম সরদারকে গ্রেফতারই করেনি। অথচ তার (চম্পার) চোখের সামনে থেকেই ডিবির ওই টিমের সদস্যরা শামীমকে তুলে নিয়ে আড়াল করেছে।
তাকেও ১০ দিন আটকে রেখেছিল মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে। চম্পা বেগমের ধারণা; তার স্বামীকে গুম করে ফেলা হয়েছে। এ অবস্থায় ওই টিমের সদস্যদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর মামলা করেন তিনি।
আদালত অভিযোগটি গুরুতর বিবেচনায় নিয়ে তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন।
চম্পা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামীকে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে অভিযুক্ত করে তুলে নিয়েছিল ঢাকা ডিবির ওই টিম।
স্বামী বেঁচে আছে না তাকে মেরে ফেলা হয়েছে দেড় বছর পরও নিশ্চিত হতে পারছি না। মেরে ফেলা হলে লাশটি পাওয়ার তো অধিকার রাখি। তিন অবোধ সন্তান তাদের বাবার জন্য কান্নাকাটি করে।
তাদের কোনো জবাব দিতে পারি না। তাদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। যদি মেরে ফেলা হয় লাশটি পেলে অন্তত কবরের পাশে গিয়ে হলেও দাঁড়াতে পারতাম। সন্তানদের বলতে
পারতাম- এই তোমাদের বাবার কবর। এখন তো কিছুই করতে পারি না। এভাবে আর কতদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে।’ তিন অবোধ সন্তানের কাছে বাবার ছবিই স্মৃতি হয়ে আছে।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৩১ জুলাই ভোরে সীতাকুণ্ডের ফকিরহাট এলাকায় শামীম সরদারের মোটর গ্যারেজের সামনে এসে দাঁড়ায় দুটি মাইক্রোবাস।
মাইক্রোবাস থেকে নেমে কয়েকজন নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে মোটর গ্যারেজে অবৈধ মাল আছে বলে দাবি করে। শামীম সরদার ও গ্যারেজে থাকা অন্য ৫ জনকে আটক করে তারা।
দাবি করে ৫০ লাখ টাকা। এ সময় শামীম সরদারকে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে শামীম সরদারেরর মোবাইল ফোন নিয়ে এক ডিবি সদস্য তার (শামীম সরদারের) স্ত্রী চম্পা বেগমকে ফোন করে গ্যারেজে ডাকেন।
উদ্বিগ্ন চম্পা বাসার দুই কাজের মেয়েসহ বাসার কাছেই অবস্থিত ওই গ্যারেজে যান। সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও টেনেহিঁচড়ে তোলা হয় গাড়িতে। একটি হায়েস ও একটি নোহা মাইক্রোবাসে সালাহ উদ্দিন, জাকির হোসেন, আলাউদ্দিন, কামাল হোসেন, শামীম সরদারের দুই কাজের মেয়েসহ ৯ জনকে নিয়ে ডিবির টিম ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়।
চম্পা বেগম ও তার স্বামী একই গাড়িতে ছিলেন। ডিবির দুই সদস্য বিপ্লব কুমার শীল ও মোতাহের হোসেন মিলে শামীম সরদারকে মারধর করেন। তারা প্লাস দিয়ে শামীমের হাত ও পায়ের নখ তুলে ফেলেন। এ সময় অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন শামীম।
স্বামীকে নির্যাতন না করতে আকুতি জানাতে গিয়ে ডিবির দুই সদস্যের হামলার শিকার হন চম্পা বেগমও। কুমিল্লায় পৌঁছার পর গাড়ি থেকে আলাদা করার সময় চম্পা বেগমকে বলা হয়- শামীম সরদারকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে।
মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, ডিবির ওই টিম তাদের ওই দিন বিকাল ৫টার দিকে ঢাকার মিন্টো রোডে অবস্থিত ডিবি অফিসে বসিয়ে রাখে। এ সময় স্বামীর কথা জানতে চাইলে তাকে জানানো হয়- ডিবির হাজতখানায় রাখা হয়েছে শামীমকে।
৩১ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত আটকে রাখে তাদের। ৮ আগস্ট রাতে চম্পা বেগম ও তার দুই কাজের মেয়েসহ অন্যদের নিয়ে ডিবি অফিস থেকে মাইক্রোবাসে তুলে চট্টগ্রামের দিকে রওনা দেয় মোতাহের হোসেনসহ ডিবির অন্য সদস্যরা। গভীর রাতে সীতাকুণ্ডে তাদের বাসার সামনে নামিয়ে দেয়া হয়।
ডিবির সদস্যরা শামীম সরদারের মালিকানাধীন একটি নোহা মাইক্রোবাসও নিয়ে যায়। স্বামী ও গাড়ি ফেরত দেয়ার কথা বলে ডিবি সদস্য মোতাহের হোসেন তিন দফায় চম্পা বেগমের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।
স্বামী কোথায় আছে জানতে চাইলে মোতাহের হোসেন কখনও বলেন, তার স্বামী গাজীপুর জেলে, কখনও বলেন সিলেট জেলে, আবার কখনও চিকিৎসাধীন আছেন বলে জানান। সর্বশেষ আবারও মোতাহের হোসেন ১০ লাখ টাকা দাবি করেন চম্পা বেগমের কাছে। তবে এরই মধ্যে মোতাহের হোসেন আইনজীবীর মাধ্যমে আদালত থেকে শামীম সরদারের নোহা মাইক্রোবাসটি ছাড়িয়ে দেন।
স্বামীকে ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে আবারও টাকা দাবি করলে অপারগতা প্রকাশ করেন চম্পা। একপর্যায়ে মোতাহের হোসেন সাফ জানিয়ে দেন- শামীম সরদারকে তারা গ্রেফতারই করেননি।
দেড় বছর ধরে স্বামীকে ফেরত দেয়ার কথা বলে মোতাহের হোসেন দফায় দফায় তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিঃস্ব করে দিচ্ছে বুঝতে পেরে চম্পা বেগম গত বছরের ৬ জুন পুলিশের আইজির কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে অনুলিপি প্রদান করেন। ওই চিঠিতে তিনি স্বামীর সন্ধান চান। আইজিপিকে চিঠি প্রদানের
পর তাকে ঢাকায় কয়েক দফা ডেকে জবানবন্দি নিয়েছেন একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। শেষ পর্যন্ত স্বামীকে তুলে নেয়ার অভিযোগে ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন চম্পা বেগম।
মামলায় আসামি করা হয়েছে- বিপ্লব কুমার শীল (পরিদর্শক নিরস্ত্র) বর্তমানে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট, এসআই অহিদুর রহমান, এসআই মো. আবদুর রউফ তালুকদার, এসআই অহিদুর রহমান, এসআই নৃপেন কুমার ভৌমিক, এএসআই মো. মোতাহের হোসেন, এএসআই মোহাম্মদ জহুরুল হক, মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম, কনস্টেবল বিনয় বিকাশ চাকমা, কনস্টেবল আফজাল হোসেন ও কনস্টেবল আবদুর রশীদ। আসামিদের সবাই ঢাকা ডিবি ও কাউন্টার টেরোজিম ইউনিটে কর্মরত বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মর্যাদার একজন কর্মকর্তা নিয়োগ এবং এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেন পিবিআইকে।
পিবিআইর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী আবদুর রহমান রহিমকে তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) নিয়োগ করেন। পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিদর্শক রুস্তম আলী যুগান্তরকে বলেন, ওই মামলাটির তদন্ত শুরু করেছিলেন আইও।
কিন্তু উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য তিনি এরই মধ্যে বিদেশে গেছেন। বিষয়টি পিবিআই থেকে কোর্টকে জানানো হয়েছে। কোর্ট নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।
এ মামলার ফাইলিং লয়ার মুজিবুর রহমান চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, অপরাধটি অত্যন্ত গুরুতর। প্রশাসনের লোকজন একদিকে গ্রেফতারের পর আসামিকে গুম করবে আবার সেই আসামিকে ফেরত দেয়ার কথা বলে ভিকটিমের পরিবারের কাছ থেকে টাকাহাতিয়ে নেবে। এটা প্রশাসনের জন্য কলঙ্কজনক।
এ ঘটনার সঠিক তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিবির ওই টিম প্রথমে সালাহ উদ্দিন নামে একজনকে তিন লাখ পিস ইয়াবাসহ আটক করে। সালাহ উদ্দিনের বাড়ি কক্সবাজার জেলায়। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে শামীম সরদারের সীতাকুণ্ডের ফকিরহাটের গ্যারেজে হানা দেয়। গ্যারেজ থেকে শামীম সরদারকে আটক করে। উদ্ধার করে ১৬ লাখ পিস ইয়াবা।
কিন্তু পরে ২ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধারের অভিযোগে ঢাকার সবুজবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়। ওই মামলায় সালাহ উদ্দিন, জাকির ও সালাহ উদ্দিনের গাড়িচালক খাইরুলকে আসামি হিসেবে দেখানো হয়। এ মামলার বাদী খিলক্ষেত থানার এসআই নৃপেন কুমার ভৌমিক। মামলাটি করা হয় ২০১৬ সালের ৩ আগস্ট।
৩ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধারের একটি মামলা দেয়া হয় ঢাকার খিলক্ষেত থানায়। ওই মামলায় শামীম সরদারের মামাতো ভাই ইব্রাহিম, মামাতো বোনের স্বামী কামাল ও শামীম সরদারের গ্যারেজের ডেন্টিং মিস্ত্রি আলাউদ্দিনকে আসামি করা হয়।
এ মামলার বাদী বিপ্লব কুমার শীল। চট্টগ্রাম থেকে ৭ জনকে আটক করা হলেও দুই মামলায় শামীম সরদার ছাড়া অন্য ৬ জনকে আসামি দেখানো হয়েছে। সূত্র জানায়, ১৬ লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হলেও বাকি ১১ লাখ পিস ইয়াবা আত্মসাৎ করা হয়েছে। শামীম সরদারকে করা হয়েছে গুম।
শামীম সরদারের স্ত্রী চম্পা বেগম যুগান্তরকে বলেছেন, তার স্বামী পরিবহন ব্যবসা করতেন। ইয়াবা ব্যবসা করতেন কিনা সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
শামীম সরদার বরিশাল জেলার বাসিন্দা। তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতি করতেন, কোনো পদ-পদবিতে ছিলেন না। বরিশালের মাধবপাশা ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হিসেবে একবার নির্বাচন করে স্বল্প ভোটে হেরে যান। চট্টগ্রামে তার ছিল পরিবহন ব্যবসা। শামীমের দুই ছেলে, এক মেয়ে।
বড় ছেলে শফিউল আলম সাকিব (১৪) নগরীর কাট্টরী মোস্তফা হাকিম স্কুলে ১০ম শ্রেণীতে পড়ে। রাইনুল আলম আকিব প্রভাতী শিক্ষা নিকেতনে ৫ম ও আনিকা আক্তার ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ে।
চম্পা বেগম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার হারানোর আর কিছুই নেই। যা হারানোর হারিয়েছি। ঘটনা সত্য বলেই আমি ১০ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছি।
আমার স্বামীকে ফেরত দেয়ার কথা বলে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ডিবি সদস্য এএসআই মোতাহের। তিনিই আমার স্বামীকে ফেরত দেয়ার কথা বলে আমাকে ধোঁকা দিয়েছেন।
আমি মিন্টো রোডে ডিবি অফিসে আটক ছিলাম। পরেও স্বামীর খোঁজে অনেকবার গিয়েছি। পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে স্বামীর সন্ধান চেয়ে আকুতি জানিয়েছি। স্বামীকে ফিরে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মামলা করতে বাধ্য হয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামী শামীম সরদারের ব্যবহৃত মোবাইল সিম এখন ব্যবহার করেন সালাহ উদ্দিনের স্ত্রী। শামীম সরদারের সঙ্গে তাকেও আটক করা হয়েছিল। মোতাহের হোসেনই আদালতের মাধ্যমে নোহা মাইক্রোবাস ছাড়িয়ে দিয়েছেন।
আমি তার বাসায় গিয়েছি স্বামীকে পাওয়ার আশায়। ঢাকার দুই থানায় ইয়াবার যে মামলা করা হয়েছে সেই মামলার আসামিদের তিনজনই আমার স্বামীর নিকটাত্মীয়।
যারা কখনও ঢাকায় আসেননি। বেড়াতে এসে শামীম সরদারের গ্যারেজ থেকে গ্রেফতার হয়ে এখনও জেলে ধুঁকছেন। আমি যতদূর জানি, আমার স্বামীসহ তারা কেউ ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত নয়।